শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৭ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম : রাজধানীতে ইতালীয় নাগরিক খুনের এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা রংপুরে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হয়েছেন জাপানের এক নাগরিক। ঢাকায় কূটনীতিক পাড়ায় ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালির চেজারে তাভেলার খুনিদের মতো রংপুরের এক অজপাড়াগাঁয়ে হোসি কোনিওকে হত্যা করতে দুর্বৃত্তরা মোটর সাইকেল ব্যবহার করে। খুনিরা মুখোশপরা ছিল বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন রংপুরের পুলিশ সুপার আব্দুর রাজ্জাক। গতকাল শনিবার বেলা ১১টার কিছুক্ষণ আগে কাউনিয়া উপজেলার আলুটারি মহিষওয়ালা মোড়ে হোসি কোনিও খামারে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তের কবলে পড়েন। দুর্বৃত্তরা তাকে কয়েক রাউ- গুলি করে পালিয়ে যায়। জাপানি নাগরিকের খুনের পর দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের সতর্কতার সঙ্গে বাংলাদেশে চলাচলের নির্দেশনা জারী করেছে ঢাকাস্থ দক্ষিণ কোরিয়া দূতাবাস। এর আগে আমেরিকা, ব্রিটেন, ব্রাজিল, অষ্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ ‘বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা দিয়ে তাদের নাগরিকদের প্রতি একই সতর্কতা জারী করে। আর নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে বৃটেনের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও অষ্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল ঢাকা সফর স্থাগিত করে। ইতালির নাগরিকের খুনের খবরের মতোই জাপানের নাগকির খুনের খবর বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলো ফলাও করে প্রচার করে। ঢাকাস্থ দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাসের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে বলা হয়, স্থানীয় গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী ৩ অক্টোবর সকালে রংপুরের কাউনিয়া এলাকায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা একজন জাপানি নাগরিককে গুলি করে হত্যা করেছে। এ অবস্থায় কোরিয়ান নাগরিকদের সতর্কতা অবলম্বন এবং সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে সর্বদা সবস্থানে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশান ২ নম্বরের ৯০ নম্বর সড়কের ফুটপাতে ইতালির নাগরিক সিজারকে (৫০) গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আইসিসিও কো-অপারেশন নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রুফ (প্রফিটেবল অপরচুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি) কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন। রংপুর শহরের মুন্সিপাড়ার স্থানীয় একটি পরিবারের দুই ভাই জাপানে থাকেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে কোনিও বাংলাদেশে আসেন। তিনি রংপুর শহরের মুন্সিপাড়ায় থাকতেন। তিনি ঘাসের চাষ করতেন। গতকাল রংপুর শহর থেকে কাউনিয়া উপজেলায় আলুটারী গ্রামে লিজ নেয়া ওই ঘাসের খামারে যাবার পথে আলুটারী নামক গ্রামে এ হত্যাকা- ঘটে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চারজনকে আটক করেছে পুলিশ। জানা যায়, হোসি কোনিও এক বছরের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন এবং চার মাস আগে রংপুর শহরের মুন্সিপাড়া এলাকায় গোলাম জাকারিয়া বালা নামে এক ব্যক্তির বাড়ি ভাড়া করেন। তারপর থেকে সেখানেই থাকতেন। হোসি কোনিও রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার আলুটারি গ্রামে জনৈক শাহ আলম মিয়ার দুই একর জমি লিজ নিয়ে গরুর ঘাঁস উৎপাদনে খামার শুরু করেন। প্রতিদিনই তিনি মুন্সিপাড়াস্থ ভাড়া বাড়ি থেকে খামারে যেতেন। অন্যান্য দিনের মতো শনিবার সকালেও তিনি রিকশাযোগে বাড়ি থেকে খামারের উদ্দেশে বের হন। রিকশায় যাবার পথে সকাল ১১টার দিকে মাহিগঞ্জের অদূরে আলুটারী গ্রামে তার খামারের কাছাকাছি এলাকায় জনৈক মুরাদ হোসেন বাবুর বাড়ির সামনে পৌঁছলে তিনজন মোটরসাইকেল আরোহী হঠাৎ তাকে এলোপাথারী গুলি করে। অতঃপর দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যান। হোসি কোনিও বুকে ও গলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে রিকশা থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অকর্স্মাৎ এ ঘটনার পর এলাকাবাসী ছুটে আসেন। তারা গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত বিদেশীকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতাল পৌঁছার আগে পথেই তিনি মারা যান। হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানিয়েছেন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে। বাড়িওয়ালা একেএম জাকারিয়া বালা সাংবাদিকদের জানান, আলুটারী গ্রামে র্তার (জাপানি) একটি প্রকল্প আছে। সেখানে দুই একরের বেশি জমিতে তিনি গরুর জন্য নেপিআর ঘাস আবাদ করতেন। প্রতিদিনের মতো শনিবার সকালেও তিনি কাজে বের হন। পরে তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি হাসপাতালে ছুটে আসেন। জাকারিয়ার তথ্যমতে, তিনি নিজেও দীর্ঘদিন জাপানে ছিলেন। তাঁর পরিবারের অনেকে এখনো জাপানে থাকেন। এই সূত্রে জাপানি নাগরিক কোনিও বাংলাদেশে তাঁর বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। তিনি একাই থাকতেন। পুলিশ জানায়, মান্নাফ হোসেন নামের এক রিকশাচালক প্রতিদিন সকালে শহর থেকে জাপানি নাগরিক কোনিওকে খামারে নিয়ে যেতেন। রিকশাচালক জানিয়েছেন, মুন্সিপাড়ার হিরা নামে একজন প্রতিদিন এই জাপানির সঙ্গে রিকশায় এলেও শনিবার তিনি আসেননি। কোনিওর সঙ্গে থাকা পাসপোর্টটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার বয়স ৬৬ বছর। তার ভিসার মেয়াদ রয়েছে ২০১৬ সালের ৩১ মে পর্যন্ত।সরেজমিন ঘুরে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বললে প্রত্যক্ষদর্শী মোকছেদুল ও আফছার জানান, মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তদের একজন মাহিগঞ্জ-হারাগাছ রোডের ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলো। অপর দুইজন তাকে এলোপাথাড়ি গুলি করে নম্বরবিহীন ওই মোটরসাইকেলযোগে হারাগাছের দিকে দ্রুত চলে যায়। স্থানীয় লোকজন আরো জানান, জাপানি ওই নাগরিক আগে তার ব্যবসায়িক অংশীদার হীরাসহ খামারে আসলেও কিছুদিন ধরে তিনি একাই খামারে আসা-যাওয়া ও দেখাশোনা করতেন। ঘটনার পরপরই হাসপাতালে ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রংপুর পুলিশ সুপার আব্দুর রাজ্জাক, পিবিআই প্রধান আব্দুস সালামসহ পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের মতে নাশকতাকারীরা পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ঘটনায় নগরীর মুন্সিপাড়াস্থ বাড়ির মালিক জাকারিয়া বালা, ব্যবসায়ীক অংশীদার হীরা, ঘটনাস্থলের বাড়ির মালিক মুরাদ হোসেন ও রিকশাচালক মান্নাফ হোসেনকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ধরতে শহরের বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি শুরু করেছে। রংপুরের পুলিশ সুপার আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, কোনিও এ বছর মে মাসে বাংলাদেশে আসেন। তিনি আলুটারী গ্রামের শাহ আলমের জমি ইজারা নিয়ে একটি ঘাসের খামার করেছেন। রংপুর শহরের মুন্সিপাড়ার জাকারিয়া নামে একজনের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন এই জাপানি। তার দুই ভাই জাপানে থাকেন, যাদের মাধ্যমে কোনিওর বাংলাদেশে আসা এবং খামার ইজারা নেয়। রিকশাচালককে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, কোনিও আজ সকালেও রিকশায় করে মাহিগঞ্জ-হারাগাছ সড়ক থেকে একটি কাঁচা রাস্তা ধরে ৫০০ গজ দূরে নিজের ইজারা নেয়া খামারের দিকে যাচ্ছিলেন। দুর্বৃত্তরা কোনিওকে গুলি করে দ্রুত দৌড়ে মোটর সাইকেলে উঠে পালিয়ে যায়। পরে পাশের বাড়ি থেকে মুরাদ বের হয়ে কোনিওকে একটি অটোরিকশায় তুলে হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। রংপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, মাল্টিপল ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন কোনিও। একটি প্রজেক্ট তৈরি করে ফান্ড গঠনে সহায়তা করছিলেন তিনি। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রংপুরের দায়িত্বে নিয়োজিত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুস সালাম বেলা আড়াইটার দিকে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি পুরোপুরি তদন্ত না করে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে যেখানে এ হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে সে স্থানটি ঘিরে রেখেছে পুলিশ। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। এখানে আন্তর্জাতিক বিষয় জড়িত। আমরা বিষয়টি উদ্ঘাটনে যত প্রযুক্তি আছে, সবই প্রয়োগ করার চেষ্টা করছি। জেলা পুলিশ সুপার ছাড়াও জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার ও র্যাব-১৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কিসমৎ হায়াত ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। উল্লেখ্য, গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে চেসারে তাবেলা (৫০) নামের ইতালির এক নাগরিককে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি গুলশানে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর হত্যা রহস্য উদঘাটনে কাজ করছে পুলিশ। ঠিক সেই মুহূর্তে রংপুরে একই ধরনের ঘটনা ঘটল।